Close Ad close
Breaking
Thu. Nov 21st, 2024

সুন্দরবন – পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন

সুন্দরবন – বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর এক প্রাকৃতিক বিষ্ময় সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বাসস্থান সুন্দরবন কে, ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন সম্পর্কে জানব শুকতারা Tv র এই পর্বে।

সুন্দরবনের পরিচিতি

নামকরণ বাংলায় সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। সুন্দরী গাছ থেকে এই সুন্দরবনের নামকরণ হয়েছে।
অবস্থান খুলনা বিভাগ (বাংলাদেশ)

পশ্চিমবঙ্গ (ভারত)

স্থানাঙ্ক ২১°৫৭′ উত্তর ৮৯°১১′ পূর্ব
আয়তন ১,৩৯,৫০০ হেক্টর (৩,৪৫,০০০ একর)
ধরন প্রাকৃতিক
অঞ্চল এশিয়া প্যাসিফিক

সুন্দরবনের অবস্থান

সুন্দরবনের আক্ষরিক অর্থ সুন্দর জঙ্গল বা বনভূমি হলেও, ধারণা করা হয় এ বনে থাকা সুন্দরী গাছের আধিক্যের কারণে এমন নামকরণ করা হয়েছে। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই বন অতীতে “সমুদ্র বন” হিসেবেও পরিচিত ছিল। সুন্দরবন অঞ্চলের প্রাচীন আদিবাসীরা এই বনকে ডাকত “চন্দ্র-বান্ধে” নামে। সরকারি হিসেব মতে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বলা হলেও, বর্তমানে বনের আয়তন তারচেয়ে অনেক কম। তবে এককভাবে সুন্দরবনই এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। যে সমস্ত উদ্ভিদ সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা জলে জন্মে তাদেরকে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ বলা হয়। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের অন্যতম বৈশিষ্ট হল এদের শ্বাসমূল। জলের উপরে জেগে থাকা এসব শ্বাসমূলের ডগায় থাকে শ্বাসছিদ্র। সুন্দরবনে জন্মানো বহু বৃক্ষের মধ্যে একটি বড় অংশই হল ম্যানগ্রোভ প্রজাতির। বিস্তুৃত এই বনভূমিটি বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশের মধ্যে অবস্থিত। উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর, সুন্দরবনের ৩ ভাগের ১ ভাগ অঞ্চল পায় ভারত এবং বাকি ২ ভাগ পায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলা জুড়ে। এবং সুন্দরবনের ভারতীয় অংশ পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের উত্তর চব্বিশ পরগণা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলায় অবস্থিত।

সুন্দরবনের আয়তনের একটি বিরাট অংশ হল জলাধার। সুন্দরবনের মধ্যে অবস্থিত নদী ও খাড়ি সহ এর জলাধারের আয়তন প্রায় ১ হাজার ৮০০ বর্গ কিলোমিটার। সমগ্র সুন্দরবন জুড়ে জালের মত ছড়িয়ে রয়েছে ছোট বড় বিভিন্ন খাল। সুন্দরবনের নদীগুলো মিষ্টি জল ও নোনা জলে মিলনস্থল। হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর নদীর প্রবাহের ফলে সঞ্চিত পলি দ্বারা গড়ে উঠেছে এই ভূখন্ড। সমুদ্রতল থেকে সুন্দরবনের উচ্চতা স্থানভেদে ২ ফুট থেকে ৭ ফুট। সুন্দরবনের ভুমির মধ্যে রয়েছে সৈকত, মোহনা, স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী জলাভূমি, কাদা চর, বালিয়াড়ি ও ছোট বড় বহু দ্বীপের মত বৈচিত্র।

সুন্দরবনের ইতিহাস

মুঘল আমলে পুরো সুন্দরবনের ইজারা লাভ করেন স্থানীয় এক রাজা। পরবর্তীতে ১৭৫৭ সালে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর এর কাছ থেকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি সুন্দরবনের কর্তৃত্ব লাভ করে। পরবর্তীতে ১৮২৮ সালে সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধীকার অর্জন করে বৃটিশ সরকার। এরপর ১৮২৯ সালে সুন্দরবনে প্রথম জরিপ কার্যক্রম চালানো হয়। কিন্তু তৎকালীন সুন্দর বন ছিল বাঘ ও অন্যান্য বন্য জন্তুতে পরিপূর্ণ। ফলে সেই জরিপ করার প্রচেষ্টা খুব একটা সফল হতে পারেনি। ১৮৬০ সালে তৎকালীন বাংলা প্রদেশে বন বিভাগ স্থাপনের পর বনাঞ্চলটি প্রথমবারের মত সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আসে। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮৭৯ সালে বন ব্যবস্থাপনার জন্য বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সদর দপ্তর ছিল খুলনায়। ১৮৭৯ সালেই সমগ্র সুন্দরবনের দায়িত্ব বন বিভাগের উপর অর্পন করা হয়। তখন হুগলী নদীর মোহনা থেকে মেঘনা নদীর মোহনা পর্যন্ত প্রায় ১৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত হয়।

সুন্দরবনের উদ্ভিদবৈচিত্র্য

সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বনভূমির মাটি ও বাস্তুসংস্থান সারা বিশ্বের এক অনন্য নিদর্শন। সামুদ্রিক জোয়ারভাটার কারণে এ বনভূমিতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জলাবদ্ধতা তৈরী হয়। ফলে বনের মাটিতে লবণাক্ততার মাত্র অনেক বেশি। এই বিশেষ অবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য এ বনের গাছপালার ধরনও সাধারণ বনের চেয়ে ভিন্ন। এই অপরূপ প্রাকৃতিক নিদর্শন শুধু বৃক্ষরাজির জন্যই নয়, এর নানা জাতের বন্যপ্রানী ও জীববৈচিত্রের জন্যও বিখ্যাত। ১৯০৩ সালে তৎকালীন বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার পরিচালক ডেভিড প্রেইন, সুন্দরবনের উদ্ভিদকুল নিয়ে সর্বপ্রথম বিস্তারিত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ঋষড়ৎধ ড়ভ ঃযব ঝঁহফৎরনঁহং গ্রন্থে তিনি সুন্দরবনে ৩৩৪টি উদ্ভিদ প্রজাতি আছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিডও পাওয়া যায় এই বনে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, পৃথিবীতে মোট ৫০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ আছে, তারমধ্যে ৩৫টি প্রজাতিই সুন্দরবনে দেখতে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের প্রধান বৃক্ষ প্রজাতি হল সুন্দরী ও গেওয়া। এছাড়া পশুর, ধুন্দল, গরান, বাইন, কাঁকড়া, কেওড়া ইত্যাদি গাছও এ বনের অন্যতম অংশ।

সুন্দরবনের জীবমন্ডল

সুন্দরবনের অনন্য জীববৈচিত্রের প্রধান আকর্ষণ হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই প্রজাতির বাঘের প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। অতীতে একসময় এই প্রজাতির অধিকাংশ বাঘই ছিল এই অঞ্চলে। বর্তমানে এদরকে বিপন্ন প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও সুন্দরবনে প্রায় ২৮৯ প্রজাতির স্থলজ প্রাণী বাস করে। এছাড়া প্রায় ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর এবং বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ ২১৯ প্রজাতির জলজ প্রাণী রয়েছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের উল্লেখযোগ্য স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলো হল, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বন বিড়াল, সজারু এবং বন্য শূকর। প্রায় ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় সদস্য মোহনার কুমির। সুন্দরবনের সাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাজগোখরা, অজগর ও কেউটে। অমেরুদন্ডী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে প্রায় ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া এবং কয়েক প্রজাতির শামুক ও ঝিনুক। সুন্দরবনে বসবাসকারী অধিকাংশ পাখিই স্থানীয়। তবে হাঁস জাতীয় প্রায় ৫০ প্রজাতির পরিযায়ী পাখিও এখানে দেখা যায়। এছাড়া সুন্দরবনের কীটপতঙ্গের বৈচিত্রও সীমাহীন।

বিগত দুইশ বছরে সুন্দরবনের আয়তন কমে গেছে প্রায় অর্ধেক। এভাবে চলতে থাকলে আগামী একশ বছরের মধ্যে এই বন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বনের উপর মানুষের অধিক নির্ভরশীলতার কারনে ক্রমান্বয়ে এর আয়তন অতি দ্রুত সংকুচিত হয়ে আসছে। বনের আয়তনের সাথে সাথে হ্রাস পাচ্ছে এর জীববৈচিত্র। সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার সহ, ২ প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং ৫ প্রজাতির স্তনপায়ী প্রাণী বর্তমানে সরাসরি হুমকির মুখে। জীববৈচিত্র রক্ষার জন্য সুন্দরবনে একাধিক অভয়ারণ্য গড়ে তোলা হয়েছে, কিন্তু তারপরও থেমে নেই এই বনের ক্ষতিসাধন। সুন্দরবনের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি চলছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বনাঞ্চল আমাজন জুড়ে। পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ এই আমাজন বনে ২০১৯ সালের আগস্টে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটে। আমাজন বনে গবাদি পশুর চারণভূমি তৈরী করতে ও কৃষিকাজের জন্য প্রতিবছর স্থানীয় কৃষকেরা আমাজনে আগুন দিয়ে বন পরিষ্কার করে। এবছর এ ধরনের অগ্নিকান্ডের সংখ্যা বিগত বছর গুলোর তুলনায় প্রায় ৮৫ গুণ বেশি। চলতি বছরের এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে প্রতি মিনিটে পুড়েছে একেকটি ফুটবল মাঠের সমানা আকৃতির বনাঞ্চল। সেই সাথে পুড়ে মরেছে এই বনে বসবাস করা বহু জীবজন্তু। এবারের আগুন এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, বন থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার দূরে ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের আকাশ এই আগুনের ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এই অগ্নিকান্ডের সামগ্রিক ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ধারণা করা যাচ্ছে না। আমাজনের বনভূমি হ্রাসের মাত্রার হিসেব করে, বিশেষজ্ঞরা অনেক আগেই বলেছিল যে, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে হয়ত আমাজন সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ বছরের অগ্নিকান্ড নিশ্চিতভাবেই সেই প্রক্রিয়া কে আরো তরান্বিত করবে।

সুন্দরবন পশ্চিমবঙ্গের একটি অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র।

সুন্দরবন বেড়ানোকে দু’ ভাগে ভাগ করা যায় – এক দিকে সুন্দরবন বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভের ভগবতপুর, লোথিয়ান দ্বীপ, বনি ক্যাম্প, কলস ক্যাম্প। অন্য দিকে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের সজনেখালি, সুধন্যখালি, দোবাঁকি থেকে একেবারে বুড়ির ডাবরি পর্যন্ত।

সুন্দরবনের প্রবেশদ্বার ক্যানিংয়ের দূরত্ব কলকাতা থেকে মাত্র ৪০ কিমি। সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভের দিকে যেতে হলে শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে ক্যানিং পৌঁছে বা কলকাতার বাবুঘাট থেকে বাসে বাসন্তী-সোনাখালি পৌঁছে, সেখান থেকে লঞ্চে উঠতে হবে। গাড়িতে গেলে গোসাবার উল্টো দিকে গদখালি পর্যন্ত চলে যাওয়া যায়। তার পর লঞ্চ।

সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ বেড়ানোর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লঞ্চে রাত্রিবাস। তবে সজনেখালিতে থাকার নানান ব্যাবস্থাও আছে। জেটি ঘাটের কাছেই পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজ।

আশা করি এই পোস্টটি বা ” সুন্দরবন – পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন ” থেকে আপনি উপকৃত হবেন। প্রতিদিন এরম আশ্চর্যজনক, রোমাঞ্চকর, অজানা এবং অদ্ভুত বিষয় সম্পর্কে জানতে এই SuktaraTv.com ওয়েবসাইট ফলো করুন, ধন্যবাদ।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *