পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগর
ভারত মহাসাগরের উত্তরে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগর। এই সাগর শুধুমাত্র জলের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ নয়; এর তলে লুকিয়ে রয়েছে খনিজ তেল, গ্যাস সহ নানা মূল্যবান সম্পদ। অর্থনৈতিক গুরুত্বের পাশাপাশি, বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত অবস্থান, এই উপসাগর কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ও পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন বঙ্গোপসাগরের তীরেই অবস্থিত।
শুকতারা Tv এই পর্বে জানব পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগর সম্পর্কে।
বঙ্গোপসাগরের নামকরণ
প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে বঙ্গোপসাগরকে বলা হয়েছে মহোদধি অর্থাৎ বিরাট জলাধার। প্রাচীন মানচিত্রগুলোতে বঙ্গোপসাগর “গ্যাঞ্জেটিকাস সাইনাস” নামে পরিচিত। যার অর্থ গঙ্গা উপসাগর। এছাড়াও এটি বঙ্গসাগর ও পূর্ব মহাসাগর নামেও বিভিন্ন সময় পরিচিত ছিল। বঙ্গোপসাগরই বিশ্বের সবচেয়ে বড় উপসাগর।
বঙ্গোপসাগরের আয়তন
বঙ্গোপসাগরের আয়তন প্রায় ২১ লক্ষ ৭২ হাজার বর্গকিলোমিটার।
বঙ্গোপসাগরের গভীরতা
বঙ্গোপসাগরের সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১৫ হাজার ৪০০ ফুট এবং গড় গভীরতা প্রায় ৮ হাজার ৫০০ ফুট। ভারত মহাসাগরের উত্তর অংশে অবস্থিত এ উপসাগর অনেকটা ত্রিভূজাকৃতির।
বঙ্গোপসাগরের বিস্তার
বঙ্গোপসাগরের পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে ভারত এবং উত্তর দিকে রয়েছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগরের পূর্ব দিকে আছে মায়ানমার ও থাইল্যান্ড এবং দক্ষিণ দিকে উপাসাগরটি শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা পর্যন্ত বিস্তৃত।
বঙ্গোপসাগরের নদনদী সমূহ
বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক বৃহৎ নদী বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা এবং ভারতের মহানদী, গোদাবরী, কৃষ্ণা ও কাবেরী নদী অন্যতম। এছাড়া মায়ানমারের ইরাবতী নদীও বঙ্গোপসাগরে মিলিত রয়েছে। বিশ্বের ২৮তম দীর্ঘ নদী হিসেবে ব্রহ্মপুত্র নদ চীন, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রবন্দর
বঙ্গোপসাগরের তীরে বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগর তীরে পটুয়াখালী জেলায় বাংলাদেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর হিসেবে তৈরী করা হয়েছে পায়রা বন্দর। ২০২৩ সাল নাগাদ বন্দরের কার্যক্রম পুরোদমে চালু হলে, প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান বন্দরটি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক বানিজ্যে অংশগ্রহণ করতে পারবে। বঙ্গোপসাগর তীরে গড়ে ওঠা ভারতের বন্দরগুলো হল কলকাতা, চেন্নাই, পারাদিপ, বিশাখাপত্তম, পন্ডিচেরি ও কাকিনাদা। বঙ্গোপসাগর তীরে মিয়ানমারের সর্ববৃহৎ শহর ও সমুদ্র বন্দর হল ইয়াংগুন। বঙ্গোপসাগর তীরের এই বন্দরগুলো দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ভারত ও মায়ানমারের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগরের বিকল্প নেই। বাংলাদেশের আমদানি রপ্তানির কাজে প্রতিবছর প্রায় ৩ হাজার জাহাজ বঙ্গোপসাগর দিয়ে বিভিন্ন মহাসাগরে যাতায়াত করে। এছাড়া ভারতের সমুদ্র বানিজ্যের এক বিশাল অংশ সরাসরি বঙ্গোপসাগরের উপর নির্ভরশীল।
বঙ্গোপসাগরের দ্বীপপুঞ্জ সমূহ
বঙ্গোপসাগরের পূর্ব দিকে রয়েছে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এটিই বঙ্গোপসাগরের সবচেয়ে বড় দ্বীপপুঞ্জ। এ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৫৭২ টি দ্বীপের মধ্যে ৩৭ টি দ্বীপে জনবসতি রয়েছে, যার সবগুলোই ভারতের অন্তর্ভুক্ত। আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পর্যটন শিল্পের জন্য বিখ্যাত। বঙ্গোপসাগরের মারগুই ও চিদুবা দ্বীপপুঞ্জের বেশ কিছু দ্বীপ রয়েছে মায়ানমারের অধীনে। বাংলাদেশের অর্ন্তভুক্ত বঙ্গোপসাগরে কোন দ্বীপপুঞ্জ না থাকলেও, মূল ভূখন্ডের কাছাকাছি ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ৩৬ টির বেশি দ্বীপ রয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ হল সেন্ট মার্টিনস।
বঙ্গোপসাগরের পর্যটনকেন্দ্র
সেন্ট মার্টিনস দ্বীপটি বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। বাংলাদেশের প্রধান পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত কক্সবাজার বঙ্গোপসাগর উপকূলেই অবস্থিত।
বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসৈকত
কক্সবাজারে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন সমুদ্র সৈকত। এ সৈকতের দৈর্ঘ্য প্রায় ১২০ কিলোমিটার। বঙ্গোপসাগর পাড়ে বাংলাদেশের আরেকটি জনপ্রিয় সমুদ্র সৈকত হল কুয়াকাটা। বঙ্গোপসাগর উপকূলে থাকা ভারতের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সমুদ্র সৈকত হল দীঘা, পুরি, বকখালি, মন্দারমনি, বিশাখাপত্তনম ও মেরিনা সৈকত। এছাড়া মায়ানমারের গাপালি ও শ্রীলংকার অরুগ্রাম বঙ্গোপসাগরের জনপ্রিয় দুটি সুমদ্র সৈকত। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর ব-দ্বীপকে ঘিরে বঙ্গোপসাগর পাড়েই রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। এ বনভূমিটি বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের মধ্যে অবস্থিত।
বঙ্গোপসাগরের সম্পদ সমূহ
বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলসীমায় রয়েছে সম্পদের প্রাচুর্যতা। বঙ্গোপসাগর অসংখ্য প্রজাতির চিংড়ি ও মাছের অনুকূল আবাসস্থল। উপসাগরের সর্বত্রই মৎস্য সম্পদ থাকলেও; প্রাচুর্যতার উপর ভিত্তি করে বঙ্গোপসাগরে এখনও পর্যন্ত চারটি প্রধান মৎস্যক্ষেত্র শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রায় ৪৭৫ ধরনের মাছ পাওয়া যায়। বর্তমানে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর প্রায় ৬ লক্ষ মেট্রিক টন মাছ আহরণ করা হয় যা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ১৮ শতাংশ। এছাড়াও সামুদ্রিক শৈবাল, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ, বিভিন্ন জাতের চিংড়ি, কাঁকড়া সহ প্রায় ৩০০ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক জাতীয় প্রাণী রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায়। বঙ্গোপসাগরের তলদেশে তেল-গ্যাসসহ খনিজ পদার্থের বিশাল মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। মার্কিন জিওলোজিক্যাল সার্ভে ডিপার্টমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, শুধু অগভীর সমুদ্রেই ৮.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। এছাড়া সাগরবক্ষের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকে ৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট পরিমাণ গ্যাস মজুদের কথা প্রাথমিকভাবে জানা যায়। বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১৩ রকমের ভারী খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আটটি অত্যন্ত মূল্যবান। এছাড়াও প্রায় ১.৭৪ মিলিয়ন টন খনিজ বালুর সমাহার রয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে।
বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গভীর খাদ হিসেবে পরিচিত। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড খাদ বঙ্গোপসাগরের মহিসোপানকে কৌণিকভাবে অতিক্রম করেছে। এ খাদের প্রস্থ প্রায় ৫ থেকে ৭ কিলোমিটার। মহীসোপানের কিনারায় খাদের গভীরতা প্রায় ৪ হাজার ফুট। প্রায় ১৫শ বর্গমাইল বিস্তীর্ণ এই সামৃদ্রিক অববাহিকা তিমি, ডলফিন, হাঙ্গর ও কচ্ছপ সহ বিরল সামুদ্রিক প্রাণীর নিরাপদ প্রজননকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। যা বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সংরক্ষিত এই সামুদ্রিক অঞ্চলটিতে জীববৈচিত্রের পাশাপাশি, তেল গ্যাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যতা রয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের সাথে, সমুদ্রসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি হবার মধ্য দিয়ে, বাংলাদেশের অর্জিত বিস্তীর্ণ সমুদ্রসীমা সাগর অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরী করেছে।
বঙ্গোপসাগরের অন্যান্য
বৈশ্বিক সমুদ্র নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বঙ্গোপসাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রে মার্কিন আধিপত্য হ্রাস করতে বঙ্গোপসাগর এক কৌশলগত জলসীমা। ভারত ও চীনের সামরিক প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে, বঙ্গোপসাগরেও কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ও চীন দ্বিপক্ষীয় উত্তেজনার ফলে বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এ অঞ্চলে আগে থেকেই ভারতের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও, মায়ানমারের সমুদ্রসীমা ব্যবহার করে চীন বঙ্গোপসাগরে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। এমনকি মিয়ানমারের কোকো দ্বীপে চীনের সামরিক ঘাঁটি থাকারও গুজব রয়েছে। নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক কূটনীতি সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশও সমুদ্রকেন্দ্রীক কৌশল গ্রহণে মনোযোগী হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরে সাবমেরিন ও যুদ্ধজাহাজের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে। পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ অধিকৃত সেন্ট মার্টিন দ্বীপে, সামরিক ঘাটি নির্মাণের ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও; বাংলাদেশের নেতিবাচক মনোভাবের কারনে তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যার ফলে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন ও রুশ সামরিক প্রভাব এখনো অনুপস্থিত ।
আশা করি এই পোস্টটি ” পৃথিবীর বৃহত্তম উপসাগর বঙ্গোপসাগর ” থেকে আপনি উপকৃত হবেন। প্রতিদিন এরম আশ্চর্যজনক, রোমাঞ্চকর, অজানা এবং অদ্ভুত বিষয় সম্পর্কে জানতে এই SuktaraTv.com ওয়েবসাইট ফলো করুন, ধন্যবাদ।